১) সামষ্টিক সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে এবং আমরা তা-ই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি কমছে, বিনিয়োগ বেড়েছে, রপ্তানি আয় বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, ফরেন রিজার্ভ বেড়েছে এবং এগুলো সামষ্টিক সূচক মাত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব উন্নয়নের ফলাফল কারা ভোগ করছেন? অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ঠিক, কিন্তু দিন দিন মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে। নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষ উন্নয়নের সুবিধা থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থাৎ আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ বৈষম্যের কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি গড়পড়তায়। সবার আয় বাড়েনি।
২) স্বাস্থ্যসেবায় প্রাথমিক পর্যায়ের উন্নয়নের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। যেমন, মাতৃমৃত্যুর হার কমে এসেছে। শিশুমৃত্যুর হারও কমছে। এগুলো প্রাইমারি লেভেলের সেবা। এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়। কিন্তু সেকেন্ডারি লেভেলের সেবাও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। একজন গরিব মানুষেরও কিডনি সমস্যা হচ্ছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যান্সার হচ্ছে। সে কোথায় যাবে? সরকারি হাসপাতালে সেবা নেয়ার কথা। তা তো হচ্ছে না। গরিব মানুষের জন্য সেকেন্ডারি লেভেলের চিকিৎসাসেবা সরকারি হাসপাতালগুলো কোনোভাবেই নিশ্চিত করতে পারছে না। অথচ বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ঠিকই এসব রোগের আধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে। ওইসব হাসপাতালে কিন্তু গরিব মানুষের সেবা নেয়ার সামর্থ্য নেই।
৩) শিক্ষার উন্নয়নের নানা কথা শোনানো হচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে, এটি এখন এক বাক্যেই স্বীকার করা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়িয়ে কী লাভ, যদি মান না বাড়ে। বাংলাদেশে শিক্ষার মান এখন অত্যন্ত নিম্নমানের এবং দিন দিন এ মান আরও কমছে।
৪) সাধারণ মানুষের আবাসন নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি। কয়েকটি শহর ছাড়া সেই অর্থে আবাসন শিল্প গড়ে ওঠেনি। শহরের অধিকাংশ মানুষ ভাড়ায় থাকেন, তাদের কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। আবার শহরের বাসা-বাড়ি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আগুনে মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এমন সময়ে তো এ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
৫) বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে এসেছে। এটি বড় সংকট বলে মনে করছি। এ খাতের ঋণ প্রবাহ কমে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে, অথচ কয়েক বছর আগেও ১৬ শতাংশে ছিল। বড় বড় বিনিয়োগ করতে গিয়ে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আড়াল করে ফেলছে। তারা যথেষ্ট ব্যাংক ঋণ পায় না বললেই চলে। ব্যাংকের সামান্য অর্থ তাদের কাছে যায়। বাকি সব বড় বড় পুঁজিপতিদের দখলে। এ কারণে বিনিয়োগ সঠিক পথে হয় না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে সব জায়গাতে স্থবিরতা নেমে আসে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান হয় না এবং এ কারণে সামাজিক অস্থিরতা তীব্র হয়।
৬) উন্নয়ন কৌশলে গলদের বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। সরকারি নীতিতে গলদ আছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে উন্নয়ন সুবিধা সবাই পাচ্ছে না। বাংলাদেশে এখন যে উন্নয়নের স্লোগান চলছে, ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলেও তা ছিল। কিন্তু সে উন্নয়ন সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সামগ্রিক বণ্টনের উন্নয়ন পাকিস্তান আমলে হয়নি, এখনও হচ্ছে না। ফের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার কথা সামনে আসছে। মানুষ মানসম্মত শিক্ষা পেলে তার আর অন্যকিছুর দরকার পড়ে না। সে উঠে আসবেই। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে জনগণের পরিশ্রমের ফলাফল আসবেই।
৭) শ্রমনির্ভর শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জাপানে দেখবেন, বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা দেয়া হয়। অথচ আমরা বাণিজ্য ও সার্ভিস সেক্টরের উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত। জনবহুল দেশে শিল্পে উৎপাদনের সঙ্গে মানুষের শ্রমকে সংযুক্ত করতে না পারলে আয়ের বৈষম্য বাড়বেই। কারণ উৎপাদনের আয় তখন গুটিকয়েক মানুষের পকেটে যায়।
কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারের কোনো কৌশল দেখতে পাবেন না। দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে তো নানা প্রশ্ন! শিক্ষিত বেকারের হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রেডিং সেক্টর ও সার্ভিস সেক্টরে জোর দেয়ার কারণে এমন হচ্ছে। ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নামে কয়েকজন মানুষের কর্মসংস্থান হয়, এতে সত্যিকার শিল্পের বিকাশ হয় না।
৮) নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে। এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ চিত্র। শেয়ারবাজারে ধস হয়েই যাচ্ছে। ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। অথচ এটি তদারকি করার কথা। এ রকম জনসম্পৃক্ত প্রতিটি সেক্টর এখন মনিটরিংয়ের বাইরে। যে যার মতো কাজ করছে। কোনো সমন্বয় আছে বলে আর মনে হয় না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা আছে, স্বকীয়তা আছে। অথচ কেউ তার জায়গা থেকে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে না।
৯) শেয়ারবাজার নিয়ে ’৯০-এর দশকে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছিল সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার কথা ছিল। রাষ্ট্র, সরকার শিক্ষা নেয়নি। শিক্ষা নেয়া হয়নি বলেই ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি। যে কেলেঙ্কারির ধারাবাহিকতা এখনও বিরাজমান। কারা, কীভাবে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তা সরকার এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানের কাছে দৃশ্যমান। যারা শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাও জানেন। অথচ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
১০) গণতন্ত্র সংকুচিত হলে পুঁজির অসম বিকাশ ঘটে। এখন তাই ঘটছে। আর এ কারণেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীরা। কারণ পুঁজিই এখন ক্ষমতার উৎস। জনগণ নয়। এতে করে জনগণের স্বার্থ আর সেই অর্থে গুরুত্ব পায় না। জবাবদিহিতা নেই, সুশাসন নেই। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য কোনো স্বস্তির বার্তা দিতে পারে না। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার না থাকলে অথবা ভোটাধিকার যদি ক্ষমতায় বা অর্থের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে যায় তখন জনপ্রতিনিধি নামে মাত্র। তারা জনগণের না।
১১) মানুষের কাছে জনপ্রতিনিধিদের কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না বলে আমলারাও আর কোনো কাজে জবাবদিহি করতে অভ্যস্ত হচ্ছে না। ব্যাংকারদের জবাবদিহিতা নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। দায়িত্বশীলদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। বড় বড় দুর্নীতি করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তদন্ত নেই, বিচার নেই, শাস্তি নেই। এতে করে অন্য দুর্নীতিবাজরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকি নিয়ে একজন তরুণ উদ্যোক্তা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বিনিয়োগ করতে। সমাজে যথেষ্ট দক্ষ, উদ্যোগী মানুষ আছে। তাদের সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে বাধা দেয়া হচ্ছে। উন্নয়ন আগে নাকি গণতন্ত্র আগে এই বিতর্ক সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে। গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়নের কোনো মানে হয় না। আমি বলি গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন পাশাপাশি থাকতে হবে। এক পায়ে বেশি দূর এগুনো যায় না।
১২) সব রাস্তা বন্ধ করে শুধু উন্নয়নের কথা বললে চলবে না। কারণ উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন বা বড় বড় প্রজেক্ট করাই নয়। একটি দেহে অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। শুধু হাত-পা দৃশ্যমান দেখিয়ে আপনি বাঁচতে পারবেন না। আপনার অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ঠিক রাখতে হবে। রাজনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসনের উন্নয়ন না ঘটিয়ে আপনি টেকসই কিছু করতে পারবেন না। বিশেষ করে চিন্তা তথা মানসিক উৎকর্ষ সাধনে আপনাকে গণতান্ত্রিক অধিকার দিতেই হবে। উন্নয়ন চিন্তায় মৌলিক বিষয়গুলো গুরুত্ব না পেলে এই এগিয়ে যাওয়া এক সময় থমকে যাবেই।
১৩) বাংলাদেশের বাজেট আলোচনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার আছে বলে হয় না। বাজেট আলোচনা এখন উন্নয়ন আলোচনার মতো লোক দেখানো আলোচনা। কারণ বাজেটের সুবিধা সবাই পায় না। জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করে বাজেটের নামে একটি শ্রেণির মানুষকে সুবিধা করে দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প হয়, সে প্রকল্পের সুবিধা সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না।
১৪) ৪৮ বছর অবশ্যই কম সময় নয়। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বাংলাদেশের কাতারেই ছিল। অথচ তারা তরতর করে এগিয়ে গেছে। আমরা সেই ধারায় এগোতে পারিনি এবং সেটি রাজনৈতিক দৈন্যের কারণেই। এখনই সময় সবাই মিলে গণতন্ত্র - সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়ন এর পথে বাংলাদেশকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।